শুক্রবার, ১৬ মে, ২০১৪

শাইখ তাকি উদ্দিন আন-নাবহানি’র সংগ্রামী জীবনী

শাইখ তাকি উদ্দিন আন-নাবহানি’র সংগ্রামী জীবনী

এটা একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’লার ইচ্ছা যে আমরা মহাকালের একেবারে শেষ সময় অতিবাহিত করছি। এটা এমন এক যুগ যখন কুফরের কালো রাত আমাদের ঘিরে রেখেছে । আল্লাহ্‌’র জমিনে আল্লাহ্‌র আইন আজ নির্বাসিত, অথচ অপরাধ ও শোষণের অবাধ চর্চা সর্বত্র। ইনশাআল্লাহ্‌, এই কালো রাত একদিন শেষ হবে, খিলাফাহ’র পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নতুন দিনের সূর্য উদয় হবে, সেই সাথে যারা নির্ঘুমভাবে সৃষ্টিকর্তাকে খুশি করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে তাদের জন্য সুসংবাদ নিয়ে আসবে। এই খিলাফাহ’র ডাক, যা হারিয়ে গিয়েছিল, তা এখন মুসলিম বিশ্ব ছাড়িয়ে অমুসলিম রাষ্ট্রের মানুষের মুখে ও ছড়িয়ে পরেছে ।আলহামদুলিল্লাহ,এখনই সময় সকল অন্ধকার কে ছিন্ন করার এবং একটি উজ্জ্বল ভোরের আলো নিয়ে আসার।

এই লিখাটি শাইখ তাকি উদ্দিন আন-নাবহানি’র সংগ্রামী জীবনের বৈচিত্রময়তা তুলে ধরার জন্য একটি ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা ।যিনি হারিয়ে যাওয়া মুসলিমদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় খিলাফতের ডাক কে পুনরায় ফিরিয়ে এনেছিলেন মানুষের মাঝে । সেই শাইখ তাকি উদ্দিন আন-নাবহানি যিনি খিলাফত প্রতিষ্ঠা আন্দোলনের দল হিযবুত তাহরির এর প্রতিষ্ঠাতা আমীর। যে আন্দোলনের নেতৃত্বে আমরা আল্লাহর পক্ষ থেকে বিজয় পাওয়ার জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছি।

শাইখ তাকি উদ্দিন আন-নাবহানি (রাহিমাহুল্লাহ) এর জন্ম ও পরিচয়ঃ

শাইখ তাকি উদ্দিন বিন ইব্রাহিম বিন মুস্তাফা বিন ইসমাইল বিন ইউসুফ আন-নাবহানি।আরবি تقي الدين النبهاني;
শাইখ তাকি উদ্দিন আন-নাবহানি “আন-নাবহান” গোত্রের উত্তর ফিলিস্তিনের “আজ্জাম” নামক গ্রামে ১৯০৯ সালের ১লা জানুয়ারি জন্ম গ্রহন করেন । শাইখ তাকি উদ্দিন আন-নাবহানি এমন একটি পরিবারে জন্ম গ্রহন করেন যেই পরিবারটি জ্ঞান ও তাকওয়ার জন্য বেশ পরিচিত ছিল। তাঁর বাবা শাইখ ইব্রাহিম একজন আইনজ্ঞ ও মা’আরিফ মন্ত্রনালয়ের (শিক্ষা ও কলা) “উলুম–ই-শরই” এ বিজ্ঞ ছিলেন। তাঁর মা ও “উলুম–ই-শরই” এ বিজ্ঞ ছিলেন যা তিনি তাঁর বাবা ইউসুফ আন-নাবাহানি থেকে অর্জন করেছিলেন।

তাঁর নানা শাইখ ইউসুফ নাবহানি সম্পর্কে বিভিন্ন বর্ণনা অনুযায়ী যে তথ্য পাওয়া যায় তা অনেকটা এরকম – “শাইখ ইউসুফ বিন ইসমাইল বিন ইউসুফ বিন হাসসান বিন মোহাম্মাদ আল নাবাহানি আল শাফে’য়ী – ওরফে আবু আল মাহাসিন একজন কবি, সুফি এবং একজন জ্ঞানি ব্যাক্তি ছিলেন। তাঁকে তৎকালীন সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিচারক হিসেবে গন্য করা হত। তিনি নাবলুস এলাকার জেনিন শহরের বিচারক হিসেবে দায়িত্বপালন করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি ইস্তানবুল শহরে চলে যান যেখানে মসুল এলাকার কাভি সান্দাক শহরে বিচারকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। অতঃপর তিনি আজকিয়া ও আল-কুদস এর আদালতের প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। তারপর তিনি বেইরুতের আদালতের দায়িত্ব পান। তিনি ৪৮টি বই লিখেন।

শাইখ তাকিউদ্দিন আন নাবাহানি’র ইসলামি ব্যাক্তিত্বের পিছনে তাঁর পরিবারের ভুমিকা অনন্য। তাই, তিনি মাত্র ১৩ বছরে কোরআন হিফজ করেন। প্রথম থেকেই তাঁর নানা উসমানী খিলাফতের পক্ষে যেসব রাজনৈতিক দলের অনুসুচনা করেছিলেন তা থেকে তিনি রাজনৈতিক বোধসম্পন্ন সচেতনতা অর্জন করেন।শাইখ তাকি উদ্দিন তাঁর নানা কর্তৃক আয়োজিত শরয়ী বিধিবিধান সংক্রান্ত আলোচনা/বিতর্কে সবসময়ই উপস্থিত হতেন এবং বুদ্ধিমত্তার সাথে সমকালিন বিষয়ের উপর প্রশ্ন করতেন । তখন থেকেই তিনি তাঁর নানার চোখে অন্যরকম ভাবে ধরা পড়েন এবং তাঁর নানা তাঁর বাবকে রাজি করান উলুম-ই-শরঈ অধ্যয়নের জন্য তাঁকে আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে।

শাইখ তাকিউদ্দিন আন নাবাহানি’র বয়স যখন ষোল তখন তিনি শেখ আল আজহার ইউনিভার্সিটিতে (জামেয়াতুল আজহার) অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হোন এবং একই সালে বৃত্তিসহকারে কৃতিত্বের সাথে পাশ করেন। তাঁকে সম্মান সূচক “শুহাদা আল ঘুরবা” সার্টিফিকেট দেওয়া হয়। তারপর তিনি আল আজহার ইউনিভার্সিটির সংশ্লিষ্ট একটি বিজ্ঞান-কলেজে ভর্তি হোন। তাঁর নানার বিভিন্ন ছাত্র যেমন শাইখ মোহাম্মাদ আল খিজার (রঃ) এর পাঠদানে সর্বদা অংশগ্রহন করতেন। তৎকালীন সময়ে ছাত্রদের জন্য এ ধরণের পাঠ-চক্রে অংশগ্রহণ করার নিয়ম প্রচলিত ছিল, যার কারণে শাইখ তাকি উদ্দিন বিজ্ঞান-কলেজের ছাত্র হওয়ার পরও ইসলামি পাঠ-চক্রে অংশগ্রহন করে যেতেন। তাঁর সহপাঠী এবং শিক্ষকরাও ঈর্ষা করতেন তাঁর গভীর চিন্তা, মতামত এবং কায়রো বা অন্যান্য ইসলামি ভু-খন্ডে বিতর্কের জন্য।

পরবর্তীতে শাইখ তাকিউদ্দিন আন নাবাহানি যেসব ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন তা হল – আল আজহার ইউনিভার্সিটি থেকে ইন্টারমেডিয়েট, আল আজহার ইউনিভার্সিটি থেকে “শাহাদা তাল ঘুরবা”, কায়রো থেকে আরবি ভাষার ও সাহিত্যে ব্যাচালর ডিগ্রি (গ্র্যাজুয়েশান), আল আজহার ইউনিভার্সিটির সাথে সংশ্লিষ্ট শরয়ী আদালত সম্পর্কিত ইন্সটিটিউট “মা’হাদ আল ‘আলা” থেকে “দ্বার আল’ উলুম” ডিগ্রি, “শাহাদা তাল ‘আলামিয়াহ” – মাস্টার্স ডিগ্রি (পোস্ট গ্র্যাজুয়েশান) ১৯৩২ সালে।
গ্র্যাজুয়েশান সম্পূর্ণ হওয়ার পরে শাইখ তাকিউদ্দিন আন নাবাহানি তার জন্মস্থান ফিলিস্তিনে চলে আসেন এবং ১৯৩৩ সালে সেখানের ইসলামিক কলেজে শিক্ষকতা পেশা হিসেবে বেছে নেন ।১৯৩৮ সালে তিনি শিক্ষকতা ছেড়ে মা’আরিফ মন্ত্রনালয়ের শরীয়া শিক্ষা বিভাগে কাজ শুরু করেন। পরবর্তীতে তাঁর পদোন্নতি হয় এবং তাঁকে হাইফা নগরীর শরীয়া কোর্টের এটর্নি করে স্তানান্তর করা হয়। অতঃপর ১৯৪৬ সালে তিনি রামাল্লাহ নগরীর আদালতের বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান। ইহুদিদের দ্বারা ফিলিস্তিন ভূখণ্ড দখলের পর তিনি সিরিয়াতে চলে যান কিন্তু একই বছরে তিনি আবার ফিলিস্তিনে ফেরত আসেন এবং আল-কুদস এর শরীয়া কোর্টের বিচারক হিসেবে চাকরি করেন। তারপর তিনি ১৯৪৮ সালে শরীয়া হাই কোর্টের বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান। অতঃপর ১৯৫১ সালে তিনি বিচারক এর পদ থেকে ও সরে দাঁড়ান ।

শাইখ তাকিউদ্দিন আন নাবাহানি ছিলেন জ্ঞানের সাগর এবং প্রায় জ্ঞানের প্রায় সব শাখায় পান্ডিত্যের অধিকারী। ছিল। তাঁর ব্যাক্তিত্ব সম্ভ্রান্ত ছিল এবং তাঁর বক্তব্য অন্যকে প্রভাবিত করত। তাঁর যুক্তি অন্যকে সন্তুষ্ট করত। তিনি লক্ষ্য ছাড়া আন্দোলন, ব্যাক্তিগত আক্রমণ ও উম্মাহ’র স্বার্থ থেকে বিচ্যুত হওয়াকে খুব অপছন্দ করতেন। তিনি মানুষের ব্যাক্তিগত জীবনে মগ্ন হয়ে যাওয়াকে অবজ্ঞা করতেন। তিনি যেন রাসূলাল্লাহ (সাঃ) এর একটি হাদীসের ঠিক জীবন্ত প্রতিরুপ, যার অর্থ অনেকটা এরকম, “যে ব্যাক্তি মুসলিম উম্মাহ’র স্বার্থে নিজেকে নিযুক্ত করে না, সে তাদের মধ্যে থেকে নয়”।তিনি এই হাদীসটি বার বার ব্যাবহার করতেন এবং দলীল হিসেবে উপস্থাপন করতেন।

তিনি মাঝারি উচ্চতার, শক্ত গড়নের, কর্মঠ, প্রাণবন্ত এবং স্পষ্টভাষী বিতার্কিক। তিনি উদাহরনসহ তাঁর যুক্তিগুলো তুলে ধরতেন। তিনি যা হক (সত্য) বলে বিশ্বাস করতেন তাঁর সাথে বিন্দু পরিমাণ দেন-দরবার করতেন না। তাঁর দাড়ি মাঝারি লম্বা ছিল যাতে আধাপাকা চুল ছিল।

জুহাইর কাহালা (ইসলামি সাইন্স কলেজের প্রশাসনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত) কলেজের একজন চাকুরীজীবী ছিলেন যখন শাইখ একই কলেজে চাকরি করেন। শাইখ তাকি সম্পর্কে তিনি বলেন, “শাইখ একজন বুদ্ধিমান, ভদ্র, পরিষ্কার হৃদয়ের মানুষ ছিলেন। তাঁর ব্যাক্তিত্ব ছিল আন্তরিক, মহৎ, প্রভাবসম্পন্ন। মুসলিম উম্মাহর প্রাণকেন্দ্রে ইহুদি-বসতি’র উপস্থিতি তাঁকে প্রচন্ডভাবে ব্যাথিত করে এবং তাঁকে উদগ্রীব করে তোলে”।

শাইখ তাকিউদ্দিন আন নাবাহানি (রাহিমাহুল্লাহ) ও হিযবুত তাহরিরঃ

৪র্থ হিজরির পর যে সকল দল বা আন্দোলনের আবির্ভাব হয়েছিল সেগুলোকে শাইখ তাকি উদ্দিন আন নাবাহানি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করছিলেন, এর পিছনে কঠোর পরিশ্রম দিয়েছিলেন। তিনি তাদের কায়দা-কৌশল, চিন্তা-মতবাদ, সমাজে বিস্তার লাভ ও তাদের ব্যার্থতা পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। তিনি যেহেতু চিন্তা করেছিলেন খিলাফাহ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার জন্য একটা রাজনৈতিক দল থাকা আত্যাবশ্যকীয়, তিনি এই দৃষ্টিকোণ থেকেই দল গুলোকে নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। মোস্তফা কামাল “আতা-তুর্ক” এর হাতে যখন খিলাফাহ ধ্বংস হওয়ার পর বহু ইসলামী আন্দোলন থাকার পরও মুসলিমরা খিলাফাহ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে ব্যার্থ হয়েছে। ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিন ভু-খন্ড ইসরাইলিদের দ্বারা দখল হওয়া এবং ব্রিটিশ সরকারের মদদপুষ্ট জর্ডান, ইরাক ও ইজিপ্ট সরকারের সহায়তায় ইহুদি শক্তির সামনে সমগ্র আরবের নিঃসহায় অবস্থা তাঁর উচ্ছ্বাসকে প্রভাবিত করে। তাই তিনি মুসলিমদের পুনঃর্জাগরণের উৎসগুলো খুঁজে বের করা শুরু করেন এবং প্রথমেই তিনি উম্মাহ’র পুনর্জাগরণ এর ব্যাপারটি অবলম্বন করেন ।

১৯৫০ সালের ১লা জানুয়ারী শাইখ তাকিউদ্দিন আন নাবাহানির প্রথম বই ‘’আনকাজ ফালাস্তিন’’। এবং একই বছরের আগস্টে তার দ্বিতীয় বই ‘’রিসালাতুল আরব’’ প্রকাশ হয়। বইদুটো শুধুমাত্র চিন্তা, ‘আকীদা, উম্মাহ’র আসল বক্তব্য বা ইসলামের মূল বানী, এবং বইগুলোতে বলা হয় – ইসলামি একমাত্র ভিত্তি যার উপর আরবগণ ভর করে পুনরুজ্জীবিত হবে। আরব জাতীয়তাবাদীদের বানী হতে শেখ এর বানী ভিন্ন ছিল। আরব জাতীয়তাবাদীদের প্রচারিত বক্তব্য উম্মাহের সাথে তথা ইসলামের মূল বক্তব্য থেকে শুধু দূরত্বই বাড়িয়ে দিয়েছে, বরং উম্মাহকে পাশ্চাত্য চিন্তা-চেতনা দিয়ে ব্যস্ত রেখেছে যা ইসলামী ‘আকীদা হতে ভিন্ন। অতঃপর তিনি আরব-জাতীয়তাবাদের চিন্তা-মতবাদ নিয়ে পড়ালেখা করেন এবং তাঁর কাছে যেসকল প্রস্তাব আসত তা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করত কিন্তু সেগুলো কখনও তাঁকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি।

তিনি কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তিনি যেসকল আলেমদের সাথে পরিচয় আছে বা দেখা হয়েছে তাদের সকলের সাথে যোগাযোগ করেছেন। মুসলিম উম্মাহকে পুনরজ্জীবিত করতে এবং উম্মাহ’র পূর্বের গৌরব ফিরিয়ে নিতে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করার মতামত তাঁদের সকলের কাছে তুলে ধরেন। এজন্য তিনি সমগ্র ফিলিস্তিন ঘুরে বেড়িয়েছেন খ্যাতিমান আলেমদের এবং বুদ্ধিজীবীদের কাছে তাঁর চিন্তা-মত প্রকাশ করতে। এ উদ্দেশ্যে তিনি অনেক সেমিনার আয়োজন করতেন, আলেমদের সম্মেলন করতেন। এ সেমিনারগুলোতে তিনি উম্মাহর পুনর্জাগরণের সঠিক পদ্ধতি নিয়ে আলেমদের সাথে আলোচনা (বা বিতর্ক) করতেন এবং বলতেন যে তাঁরা ভুল পথে হাঁটছেন আর তাঁদের সকল কষ্ট বৃথা যাবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যাদের সাথে বিতর্ক করতেন তাঁদের মধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক, জাতীয়তাবাদি বা ইসলামি দলের কর্মকর্তাদের সাথে। তিনি আল আকসা মসজিদ, আল খলীল মসজিদ সহ বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক ঘটনাবলী ও বিভিন্ন দিবসে আলোচনা করতেন। তিনি প্রায়ই “আরব লীগ” এর বাস্তবতা দেখিয়ে উল্লেখ করতেন যে এটি একটি পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদের ফল এবং অনেক পাশ্চাত্য হাতিয়ারের অন্যতম যা দ্বারা মুসলিম ভুখন্ডে তাঁদের আধিপত্য বজায় রাখে। শাইখ পাশ্চাত্য ষড়যন্ত্রের মুখোশ উন্মোচন করতেন এবং মুসলিম ও ইসলাম বিরোধি নীল-নকশা উম্মাহ’র সামনে তুলে ধরতেন। তিনি মুসলিমদের দায়িত্ববোধ জাগিয়ে দিতেন এবং তাঁদের আহবান জানাতেন রাজনৈতিক দল গঠন করতে যার ভিত্তি হবে একমাত্র ইসলাম।

শাইখ তাকিউদ্দিন “প্রতিনিধিগণের সভা”র (যা শুধুমাত্র উপদেষ্টামণ্ডলীর কমিটিই ছিল) নির্বাচনে অংশগ্রহন করেছিলেন। কিন্তু তাঁর ধ্যান-ধারনা বা মতামত, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, ইসলামী দল গঠনের ব্যাপারে তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম ও ইসলামকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরা ইত্যাদি কারণে সরকার তাঁর প্রতিকূলে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করে।

কিন্তু এসবের সত্ত্বেও না তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে সরে যান, না তিনি দমে গেছেন, বরং তিনি আলোচনা বা বিতর্ক চালিয়ে গেছেন। একটি ইসলামী রাজনৈতিক দল গঠনের জন্য প্রখ্যাত আলেম, বিচারক, রাজনৈতিক চিন্তাবিদদের প্রভাবিত করার মাধ্যমে তিনি অচিরেই সাফল্যের মুখ দেখেন। অতঃপর তিনি এসব সমাজের উচুমাপের লোকদের কাছে একটি কাঠামো ও দল-এর মতবাদ উপস্থাপন করতেন। কিছু আলেম ও কিছু চিন্তাবিদ তাঁর মতবাদের সাথে একমত পোশন করেন এবং তাঁদের সম্মতি প্রকাশ করেন, এভাবে দল প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁর রাজনৈতিক তৎপরতা একেবারে শীর্ষে পৌছে।

আল-কুদস, রহমতময় নগরিতেই তার দল এর প্রতিষ্ঠার ভিত্তি প্রস্থর স্থাপন হয়েছিল, যেখানে শাইখ সুপ্রীম কোর্টে কর্মরত ছিলেন। সেসময়, তিনি বিভিন্ন আলেমদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন শুরু করেন যেমন: কালকিলা শহরের শেখ আহমাদ দা’ওর, ইজিপ্ট এর সায়্যাদান নিমর, রামাল্লাহ শহরের দাউদ হামদান, নাবলুসের আদিল, ঘানিম আব্দু, মুনির শাকির, শেখ আ’সাদ বেওয়িয প্রমুখ।

শুরুতে, প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে শুধু প্রয়োজনুসারে মিটিংগুলো সংঘঠিত হত। বেশিরভাগক্ষেত্রে আল-কুদস এবং আল-খলীল শহরে মিটিংগুলো আয়োজিত হত যার বিষয়বস্তু ছিল মানুষদের দলের চিন্তার দিকে আহবান জানানো। বিতর্কের মধ্যে মুসলিম উম্মাহ’র গৌরব-উজ্জ্বল ফিরিয়ে আনতে ইসলামি প্রয়োজনীয় বিষয়বস্তু। ১৯৫২ সাল পর্যন্ত এভাবে চলতে থাকে যতক্ষণ না এ মানুষগুলো একটা রাজনৈতিক দল গঠন করতে শপথ করে।

১৭ই নভেম্বর ১৯৫২ সালে, দল এর ৫ জন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য রাজনৈতিক দলটি প্রতিষ্ঠা করার জন্য জর্ডানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর কাছে বিধিমতাবেক “নো অবজেকসান সার্টিফিকেট” এর জন্য আবেদন জানান। এই ৫ জন সদস্য হলেন: ১) শাইখ তাকি উদ্দিন আন-নাবহানি - নেতা, ২) দাউদ হামদান – উপনেতা ও সচিব, ৩) ঘানিম আব্দুহ – অর্থ সম্পাদক, ৪) আদিল আল নাবলুসি – সদস্য ও ৫) মুনির শাকির – সদস্য। পরবর্তীতে একটি দল গঠনের জন্য তারা অটোমান আইন এর সকল আচরনবিধি সম্পন্ন করেন। দলের এর প্রধান কার্যালয় আল-কুদস এ রাখা হয় এবং যে সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করে সব অটোমান আইন অনুযায়ী বৈধতা পায়।

দলের “মৌলিক গঠনতন্ত্র ও তা প্রয়োগের শর্ত” এর দৈনিক আল-সারিহ পত্রিকার ইস্যু ১৭৬ (তারিখ: ১৪ই মার্চ ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দ, ২৮শে জুমাদ আল আউওাল ১৩৭২ হিজরি) এর প্রকাশনায় একে একটি বৈধ দল হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এর মাধ্যমে তৎকালীন অটোমান আইনে দল তাঁর কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার অধিকার পায়।
কিন্তু, সরকার ৫ জন প্রতিষ্ঠাতা সদস্যকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেয় এবং তাঁদের ৪ জন কে গ্রেপ্তারের পর জেরা শুরু করে। ২৩শে মার্চ ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দ, ৭ই রজব ১৩৭২ হিজরি সরকার একটি বিজ্ঞপ্তি জারির মাধ্যমে ঘোষণা করে যে দলটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হল এবং এর সদস্যদেরকে সমস্ত কর্মকান্ড বন্ধ করতে নির্দেশ দেওয়া হল। ১লা এপ্রিলে আল-কুদস এর কার্জ্যালয়ের সকল পোস্টার ও ব্যানার তুলে নেওয়া হয় – সরকারের নির্দেশ অনুসারে।

যাইহোক, শাইখ তাকি এ “নিষিদ্ধ” কে কোন গুরুত্ব দেয়নি বরং তিনি তাঁর কাজ চালিয়ে যান। তিনি এর প্রচারনার কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন যার জন্য এর জন্ম।

ইসলামী জীবন-ব্যাবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য আল-আকসা মসজিদের জামাত আদায় করার স্থানে এ দল মানুষদের পাঠচক্রের আয়োজন শুরু করে। তাঁদের মনোমুগ্ধকর কার্যক্রমের জন্য সরকার সস্তা চাল খেলতে শুরু করে যেন দলটি কখনো শক্তিশালী সংগঠনে রুপ না নেয়। ১৯৫৩ সালের শেষ দিকে, শাইখ তাকি এহেন পরিস্থিতিতে তাঁর স্থান পরিবর্তন করেন।

১৯৫৩ সালের নভেম্বর মাসে শেখ তাকি সিরিয়াতে পাড়ি জমান, সেখানে সিরিয়ান সরকার দ্বারা গ্রেপ্তার হন এবং তাঁকে লেবাননে পাঠিয়ে দেন কিন্তু লেবানন সরকারও তাঁকে দেশে ঢুকতে বাঁধা দেয়। আল-হারিরের থানার অফিসার ইন চার্জ কে তিনি অনুরোধ করেন তাঁর বন্ধুকে একটি ফোন-কল করার জন্য। অফিসার তাঁকে কল করতে দেয়। তিনি তাঁর বন্ধু মুফতি শেখ হাসসান আল ‘আলা কে ফোন-কল করেন এবং ঘটনা বর্ণনা করেন। শেখ আল ‘আলা সাথে সাথে পদক্ষেপ গ্রহন করেন এবং অফিসার কে ধমক দেন এই বলে যে যদি তিনি শাইখ তাকি কে লেবাননে ঢুকতে না দেন তাহলে তিনি প্রচারনা শুরু করবেন যে লেবাননের তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকার একজন অন্যদেশের বহিষ্কৃত আলেমকে দেশে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। লেবানন কর্তৃপক্ষ এটাকে হুমকি হিসেবে নেয় এবং শাইখ তাকিকে লেবাননে প্রবেশ করতে দেন।

শাইখ তাকি লেবাননে আসার পর তাঁর চিন্তা-মতবাদ প্রচারণায় নিজেকে নিয়োজিত করেন এবং ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত তেমন কোন বাঁধার সম্মুখিন হননি। যখন লেবানন সরকার তাঁর চিন্তা-ধারা’র আসন্ন বিপদকে আঁচ করতে পারলো, তখন শাইখ এর প্রতি কড়াকড়ি আরোপ শুরু করলো। তাই শাইখ বেইরুত থেকে ত্রিপোলিতে চলে যান। শাইখের কাছের বন্ধুদের কাছ থেকে জানা যায়, তিনি তখন তাঁর সময়ের বেশির ভাগ সময় পড়ালেখায় ব্যয় করতেন। তিনি রেডিও’র মাধ্যমে বিশ্বের খবর নিতেন এবং চমৎকার রাজনৈতিক পর্যালোচনা তৈরি করতেন। তিনি তাঁর নাম “তাকি” অর্থাৎ “ধার্মিক” এর মতই ধার্মিক ছিলেন। তিনি সর্বদা নিজের জিহবা সংযত রাখতেন, চোখ নামিয়ে রাখতেন। তাঁকে কখনও কোন মুসলিমকে অমার্জিত কথা বলতে শোনা যায়নি, কাউকে অপমানিতও করেননি, এমনকি যেসব দা’ইয়ি তাঁর সাথে ইজতিহাদের ক্ষেত্রে দ্বিমত পোষণ করতেন।

ইরাকে তিনি “নুসরাহ”র (সাহায্য’র)প্রতি বেশী নজর দেন মুসলিমদের পুনর্জাগরণের পথে এগিয়ে যাওয়ার পথ কে আরো সুগম করতে। এজন্য তিনি নিজে বেশ কয়েকবার ইরাকে যান কারণ সেখানে আব্দুল সালাম আরিফ এর মত অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তিত্ব ছিল।ইরাকে তাঁর অনেকগুলো যাত্রার শেষটিতে তিনি গ্রেপ্তার হোন এবং প্রচন্ডভাবে প্রহৃত হোন, শারীরিক ও মানসিকভাবে আঘাত করা হয়। কিন্তু শাইখের জেরাকারী তাঁর কাছ থেকে কোন তথ্য বের করতে ব্যর্থ হয়। তিনি শুধু এ কথাই বারবার ব্যক্ত করতে থাকেন যে, “একজন বৃদ্ধ ব্যক্তি চিকিৎসার খোঁজে”। আসলে তিনি ইরাকে গিয়েছিলেন পিছিয়ে পড়া উম্মাহকে পুনর্জাগরণ করতে। ইরাকি কর্তৃপক্ষ তাঁর কাছ থেকে কোন তথ্য না পেয়ে তাঁকে প্রচন্ডভাবে প্রহার করে ও তাঁর হাত ভেঙ্গে দেয় এবং তাঁকে দেশ থেকে বের করে দেয়, তখন তাঁর সমস্ত শরীর প্রহারের কারণে রক্তে রঞ্জিত ছিল। তিনি যখনই ইরাকের সীমানা অতিক্রম করলেন, জর্ডানের গোয়েন্দা সংস্থা ইরাকের গোয়েন্দা সংস্থাকে অভিত করলেন যে তিনিই ছিলেন শাইখ তাকি উদ্দিন যাকে ইরাকি গোয়েন্দা সংস্থা হন্য হয়ে খুজছিলো। কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ, সময়টা তাঁদের পক্ষে ছিল না, বরং শাইখ ততক্ষণে অনেক দূর পাড়ি দিয়েছেন।


উম্মাহ এ শাইখকে শেষ বিদায় জানায় শনিবার, ফজরের ওয়াক্তে, ১লা মহররম ১৩৯৮, ১১ই ডিসেম্বর ১৯৭৭ সালে যখন তার বয়স হয়েছিল ৬৮। বস্তুত, তিনি ছিলেন এক মহান নেতা, জ্ঞানের সমুদ্র, সমসাময়িক কালের অন্যতম বিচারক, ইসলামি চিন্তার পুনর্জাগরক, বিংশ শতাব্দির শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ, সত্যিকারের মুজতাহিদ এবং দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী আলেম। বেইরুতের আল-অযায়ি কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। শাইখ তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ও আত্মত্যাগের ফলাফল নিজ জীবনে ভোগ করতে পারেননি। তিনি খিলাফত রাষ্ট্র দেখে যেতে পারেননি যার জন্য দল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।কিন্তু রেখে গেছেন মুসলিম উম্মাহ কে একত্রিত করার সঠিক মতবাদ। যেই মতবাদ আজ সারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছে এবং তাঁর সেই মতবাদ সমগ্র বিশ্বে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে ।

আল্লাহ শাইখ তাকিউদ্দিন আন নাবাহানি (রাহিমাহুল্লাহর) সেই প্রচেষ্টাকে কবুল করুন, দুনিয়াতে এর পূর্ণ সফলতা দান করুন, তার উপর রহম করুন ও তাকে সর্বোচ্চ জান্নাত
দান করুন। আমীন।

শাইখের লেখা বইয়ের একটি লিস্ট নিচে দেওয়া হল:

নিযামুল ইসলাম, আত-তাকাত্তুল আল-হিজবী, মাফাহীম,ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, ইসলামী সামাজিক ব্যবস্থা, ইসলামী শাসন ব্যবস্থা, ইসলামী রাষ্ট্রের সংবিধান, সংবিধানের সূচনা (সারসংক্ষেপ), ইসলামী ব্যাক্তিত্ব, রাজনৈতিক চিন্তা, উষ্ণ আহবান, আল-খিলাফাহ, চিন্তা, মনের উপস্থিতি (প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব), সমাজে কর্তৃত্ব স্থাপন, যাত্রা শুরুর স্থান, লিস্লাহ-এ-মিসর, আল ইত্তিফাকিয়াত আস সানিয়া আল মাস্তিয়া আল সুরইয়া ওয়াল ইয়ামনিয়া, হাল কাদিহ ফালাস্তিন ‘আলা তারীকাতিল আমরিকিয়া ওয়াল ইংলিজিয়া, নাজরিয়া আল ফারাঘ আল সিয়াসি হাল মাসরো’ ইজান হাওয়ার .

এছাড়াও তাঁর লেখা শত শত বুদ্ধিবৃত্তিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পুস্তিকা আছে।

যখন তাঁর বইগুলো নিষিদ্ধ তখন তিনি তার দলের অন্যান্য সদস্যের নামে যেসব বই প্রকাশ করেন তা হল:

অর্থনৈতিক নীতি, মারক্সিস্ট কমিউনিসম এর জবাব, খিলাফাহ যেভাবে ধংস হল, ইসলামে সাক্ষ্য-প্রমানাদির (বিচারসংক্রান্ত) নিয়মকানুন, ইসলামে শাস্তি ব্যবস্থা, নামাজের নিয়মসমুহ, ইসলামী চিন্তা .

এবং দল প্রতিষ্ঠার আগে তিনি দু’টো বই লিখেছিলেন:

রিসালাতুল আরব, আনকাজ ফালাস্তিন







1 টি মন্তব্য:

  1. As stated by Stanford Medical, It's indeed the SINGLE reason women in this country live 10 years more and weigh on average 19 KG lighter than we do.

    (Just so you know, it has absolutely NOTHING to do with genetics or some hard exercise and really, EVERYTHING around "HOW" they eat.)

    P.S, What I said is "HOW", not "WHAT"...

    TAP on this link to discover if this easy test can help you unlock your true weight loss potential

    উত্তরমুছুন