শুক্রবার, ২ মে, ২০১৪

সিন্ধু বিজয়ের ইতিহাস

মুসলিমদের সিন্ধু বিজয়ের ইতিহাস
**********************
বিশ্বের রঙ্গমঞ্চে মুসলিম নামে একটি নব্য জাতির নজিরবিহীন দ্রুত উন্নতিতে ঐতিহ্যশালী প্রাচীন জাতিসমূহ ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়েছিল। পারশিক, রোমান, হিন্দু প্রভৃতি জাতিসমূহ একটি চরম সাফল্যে যে ঈর্ষা ও বিদ্বেষ অনুভব করেছিল, যদি তা মনের অন্তরালে তারা গোপন রাখতো, তাহলে সম্ভবতঃ মুসলিম সাম্রাজ্য স্বল্প সময়ের মধ্য এতো ব্যাপক প্রসার লাভ করতে পারত না। ঈর্ষা ও বিদ্বেষ শুধু ব্যক্তিকে ধ্বংস করে না, বরং জাতি ও সাম্রাজ্যের ধ্বংসেরও কারণ ঘটায়। জার্মানী ও ইতালী এবং ১ম ও ২য় বিশ্বযুদ্ধ তার জ্বলন্ত খৃস্টীয় ৭ম শতাব্দীতে পারস্য ও রোমান জাতি ঐ কাল ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে যে পরিণাম ভোগ করেছিল, তা বেশিরভাগ মানুষই জানেন। অষ্টম শতাব্দীতে আর একটি সাম্রাজ্য মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষপরায়ণ হয়ে এমন অসংগত ও অন্যায় নীতি ও কার্যপদ্ধতির আশ্রয় নিয়েছিল যে শেষ পর্যন্ত ইতিহাসের শাশ্বত বিধান মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না।

ইসলামের জন্মলগ্ন থেকে পারসিকরা এই নব্য শক্তির ধ্বংস সাধনে বিভিন্নভাবে প্রচেষ্টা চালানোর ফলে মুসলমানদের সাথে পারসিকদের সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে ওঠে। মুসলমানদের বিরুদ্ধে সিন্ধুরাজ পারসিকদের সাথে হাত মিলিয়েছিল। রাজা দাহির তার সুশিক্ষিত সৈন্যবাহিনী দিয়ে পারস্যরাজকে সাহায্য সহযোগীতা করেছিল। সিন্ধুরাজের এই মহা শত্রুতা ও বিদ্বেষমূলক আচরণের প্রেক্ষিতে মুসলমানরা পারসিকদের পর্যদুস্ত করার পর সিন্ধু আক্রমণ করতে চাইলে খলীফা ওমর তখন নিষেধ করেছিলেন। ফলে সিন্ধুর সীমানা ও পারস্যের শেষ সীমান্ত মাকরান পর্যন্ত জয় করে মুসলমানরা অভিযান স্থগিত রেখেছিল। কিন্তু মুসলমানরা বিরত থাকলেও পরাজিত পারসিকরা সম্রাটের মিত্র সিন্ধুরাজ দাহির বন্ধুর সাম্রাজ্য দখলকারীদের সুযোগমত ত্যক্ত-বিরক্ত করতে লাগলো।

আধুনিক বেলুচিস্তানের পার্বত্য অঞ্চলে তারা মুসলিম শাসনের বিরুদ্ধে জনগণকে উস্কানি দিয়েছিল এবং বিদ্রোহে সাহায্য করেছিল। ৩৮ হিজরীতে দুর্ধর্ষ বীর হারিস বিন আমর ঐ বিদ্রোহ কঠোর হস্তে দমন করেছিলেন। অনুরুপভাবে মাকরান প্রদেশে একটা বিদ্রোহ হয়েছিল, কিন্তু তা ব্যর্থ হয় এবং বিদ্রোহী নেতা মুহাম্মদ বিন আলাফি সদলবলে সিন্ধু দেশে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। বাগদাদ সরকার এক দূত প্রেরণ করে রাজা দাহিরকে আহ্বান জানিয়েছিলেন যেন তিনি বিদ্রোহীদেরকে সাহায্য না করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ খলীফার দূতকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ফলে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে তৎকালীন রীতি অনুযায়ী যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। কিন্তু খলীফা আব্দুল মালেকের অনিচ্ছার জন্য যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব হয়। তবে শত্রুতা ও বিদ্বেষ বিস্ফোরণের মুখোমুখি উপনীত হয়েছিল।

এই সময় সিংহলের মত আরব ব্যবসায়ীদের স্ত্রী-পুত্র-পরিজনদেরকে স্বদেশে পাঠাবার জন্য সিংহল রাজ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে ইসলাম গ্রহণ করে তাঁর বন্ধুরাষ্ট্র আরব সাম্রাজ্যের অধিপতি ওয়ালিদ ও ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফের নিকট প্রচুর উপটোকনসহ আরবীয় মহিলা ও শিশুদেরকে ৮টি জাহাজে করে আরবে পাঠিয়েছিলেন। সিংহলের বহু মুসলমান হজ্জব্রত পালনের জন্য জাহাজে যাত্রী হয়েছিল। আটটি জাহাজের বিশাল নিরস্ত্র বহরটি আম্মান সাগরে প্রবেশ করলে প্রতিকুল বাত্যা প্রবাহে শত্রু দেশের বন্দরে উপনীত হয়। সিন্ধুরাজের অধীনস্থ দেবল বন্দরে মুসলমানদের জাহাজ পূর্ব শত্রুতা চরিতার্থের নিমিত্তে দাহিরের কর্মচারীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়।

নির্যাতনের শিকার নিরস্ত্র নারী ও শিশুদেরকে তারা রাজধানী উল্লুর জেলে বন্ধী করে রাখে এবং প্রচার করে দেয় যে জলদস্যু গণ কর্তৃক জাহাজগুলো আক্রান্ত হয়েছে। সৌভাগ্যক্রমে আক্রান্ত জাহাজের কয়েক ব্যক্তি কোনরকমে রক্ষা পায়। রক্ষাপ্রাপ্তদের মধ্যে এক তরুণী নিজের শরীরের রক্ত দিয়ে একটি মর্মন্তুদ পত্র লিখে কোন রকমে পূর্বঞ্চলীয় গভর্নর হাজ্জাব বিন ইউসুফের নিকট পাঠিয়ে দেয়।

সিন্ধুর প্রতি বীতশ্রদ্ধ ও ক্রুদ্ধ হাজ্জাজ তখনই সিন্ধু আক্রমণ করতে পারতেন। কিন্তু তিনি নীতি লংঘন করলেন না। ভুল সংশোধনের সুযোগ দিয়ে সিন্ধু রাজকে লিখলেন যে যেহেতু দাহিরের লোকেরা মুসলিম নারী-শিশুদেরকে অসঙ্গত ও অন্যায়ভাবে বন্ধী করেছে এবং মাল-সম্পদ লুন্ঠন করেছে, সেহেতু অবিলম্বে বন্ধীদেরকে মুক্তি দিয়ে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণসহ ফেরৎ দেওয়া হোক। সিন্দুরাজ দাহির তাঁর সাম্রাজ্যের স্বার্থেই এই চরম মূহূর্তে বিষয়টির নিষ্পত্তি করতে পারতেন। রোম ও পারস্যের মতো দু’টি শক্তিধর সাম্রাজ্যের করুণ পরিণতি তাঁর সামনেই ছিল। কিন্তু নিষ্পেষিত লক্ষ-কোটি হতভাগ্য মানুষের করুণ ফরিয়াদ মহা হাকিমের দরবারে আগেই মঞ্জুর হয়ে গিয়েছিল। দাহির জানালেন যে প্রতাপশালী জলদস্যু কর্তৃক জাহাজ আক্রান্ত হয়েছে এবং তাদের উপর তার কোন প্রভাব না থাকায় তিনি কোন পদক্ষেপ নিতে পারবেন না। দাহিরের এ কৈফিয়ত হাজ্জাজকে সন্তুষ্ট করতে পারল না।

সিন্ধুরাজ দাহিরের কৃত অপরাধের উপযুক্ত শাস্তি প্রদানের জন্য হাজ্জাজ বিন ইউসুফ খলীফা ওয়ালিদের অনুমতিক্রমে পরপর দুইবার উবায়দুল্লাহ ও বুদায়েলের নেতৃত্বে দু’টি বাহিনী প্রেরণ করলেন। কিন্তু দু’টি অভিযান ব্যর্থ হলো। ক্ষিপ্ত হাজ্জাজ অবশেষে আপন ভাগিনা ও জামাতা সপ্তদশ বছর বয়স্ক মুহম্মদ বিন কাসিমকে সিন্ধু অভিযানের দায়িত্ব প্রদান করলেন।
৬ হাজার অশ্বারোহী ও ৬ হাজার উষ্ট্রারোহী সৈন্যের এক বিরাট বাহিনী ৭১২ খৃস্টাব্দে মাকরান প্রদেশের মধ্যে দিয়ে সিন্ধুর সীমান্তে পৌছুলে স্থানীয় অত্যাচারিত ও শোষিত জাঠ ও মেঠ জাতির বহু সৈন্য স্বেচ্ছায় মুসলমানদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করলো। মুহম্মদ বিন কাসিম দাহিরের ভ্রাতুষ্পুত্র ও দেবলের প্রদেশপালকে পরাভূত করে দেবল দখল করলেন।

অতঃপর তরুণ সেনাপতি ব্রাহ্মন পুরোহিত ও দাহিরের জ্ঞাতি ভ্রাতা বজ্রের নিকট থেকে সিহরওয়ান শহর ছিনিয়ে নিয়ে নিরুন তথা বর্তমান হায়দ্রাবাদের দিকে ধাবিত হলেন। অনতিবিলম্বে নিরুন ও সিস্তানে ইসলামের পতাকা উড্ডীন হলো। অতঃপর ৭১২ খৃস্টাব্দের জুন মাসে রাওয়ার নামক স্থানে স্বয়ং সিন্ধুরাজ দাহির বিশাল অশ্ববাহিনী ও হস্তিবাহিনী নিয়ে মুসলমানদের মুকাবিলা করলেন। কিন্তু মুসলমানদের বীরত্বের সামনে রাজা দাহিরের বাহিনী ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেল। রাজা দাহির নিহত হলেন। রাজার বিধবা পত্নী রানীবাই ১৫ হাজার সৈন্য নিয়ে অরোর দুর্গ থেকে সাম্রাজ্য রক্ষার শেষ চেষ্টা করেও পরাজিত হলেন এবং অগ্নিকুন্ডে ঝাঁপ দিয়ে ব্রাহ্মণ্য সাম্রাজ্যবাদের শোষণ ও নির্যাতনের সঞ্চিত অপরাধ মোচন করলেন।
অতঃপর মুহাম্মদ বিন কাসিম মূলতানের পানে অগ্রসর হলেন। নির্যাতিত মানবতার মুক্তির দূত হিসাবে স্বর্গীয় রহমত হিসাবে লাঞ্ছিত শোষিত জনগণের কাছে বরিত হতে লাগলো।
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 








কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন